সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বছরে কমপক্ষে ৬৫ কেজি পারদ সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হবে। এক চামচ পারদ কোনো মাটিতে ফেললে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। আর ওই বিপুল পরিমাণ পারদ সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংবেদনশীল স্থানে ফেললে এর অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এর বাইরে দিনে সাড়ে চার কোটি লিটার গরম ও দূষিত পানি সুন্দরবনের পশুর নদীতে ফেলা হবে। এতে সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোর পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি।
আজ শনিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে মুক্তি ভবনে জাতীয় কমিটি আয়োজিত ‘সরকার কোম্পানির মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তির জবাবে আলোচনা সভা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব’ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সভায় মূল বক্তব্য তুলে ধরেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ও মাহবুব সুমন।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বছরে ৬৫০ কেজি পারদ সুন্দরবনে ফেলা হবে। তবে খুব ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে এর ১০ শতাংশ পরিমান পারদ ফেলা হবে। আর তা হলে সেটা বছরে ৬৫ কেজির কম হবে না।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি বাতিলের দাবিতে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ২০ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দিনব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। এদিন সারা দেশের সব শহীদ মিনারেও এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
সভায় জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের ভূখণ্ডে যেসব গ্যাস কূপ আছে, তা বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা কূপ খনন না করে ছয়-সাত বছর পর চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের গ্যাসসম্পদ বাদ দিয়ে সরকার কয়লার দিকে ঝুঁকছে, যা সুন্দরবনের মতো প্রাণসম্পদে ভরপুর একটি বিশ্ব ঐতিহ্যকে ঝুঁকিতে ফেলছে। তিনি সুন্দরবন রক্ষায় একটি গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘যাঁরা বলেন সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের ওপরে আস্থা রাখুন, তাঁদের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। কিছু দালাল পরামর্শক এনে রামপাল প্রকল্পের পক্ষে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হচ্ছে।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, রামপাল প্রকল্পের আশপাশের জমিতে ইতিমধ্যে সরকারি দলের লোকজন ও সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ১৫০টি শিল্প প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন চলছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, রামপাল প্রকল্পের প্রতি ইউনিটের যে বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে, তা স্বাভাবিক দরের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। ফলে আর্থিকভাবেও রামপাল প্রকল্প লোকসানি হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বাংলাদেশি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরশাদ মনসুর এসে বলা শুরু করেছেন, ‘রামপাল প্রকল্পে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না।’ সুন্দরবন নিয়ে তিনি যে সুখের স্বর্গের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রেও রচিত হয়নি। তাঁর প্রতিষ্ঠানের আওতায় যেসব জ্বালানি কোম্পানি রয়েছে, সেসবের ৩০টির বিরুদ্ধে পরিবেশের ক্ষতি করার মামলা রয়েছে।
গবেষক মাহা মির্জা বলেন, ভারতের কয়লা বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, তাঁদের প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশের ক্ষতি করার কারণে মামলা ও জরিমানা হয়েছে। তারা কীভাবে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল জায়গায় পরিবেশ রক্ষা করবে? তাঁদের প্রতি আমরা কীভাবে এ আস্থা রাখতে পারি?
অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯-৮০ সালে ১ হাজার ২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সময়ও স্থানীয় মানুষকে এভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে বোঝা না গেলেও পরে দেখা যায়, সেখানের পেকান বৃক্ষগুলো (একধরনের শক্ত বাদাম, কাজুবাদামের মতো) একে একে মরতে শুরু করে। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের হিসাবে ফায়েত্তি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস, বিশেষ করে সালফার ডাই-অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় পেকান, এলম, ওকসহ বিভিন্ন জাতের গাছ আক্রান্ত হয়েছে। বহু পেকান–বাগান ধ্বংস হয়েছে। এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরেও পৌঁছে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কারও কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে তাকে বোঝানো সম্ভব হয়। কিন্তু কেউ যদি আগে থেকেই ঠিক করে নেয় সে বুঝবে না, তবে তাকে কোনো শিক্ষক, বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ-প্রকৌশলী বোঝাতে পারবে না। আমাদের সরকারও এ অবস্থানে আছে।’
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বাতিল দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতে জাতীয় কমিটি যাবে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বন্ধ করার দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ সংগঠন হিসেবে জাতীয় কমিটির নেই। তাই এখানকার জনগণই ভরসা। আন্তর্জাতিকভাবে জনমত তৈরি করতে পারি আমরা। এ ছাড়া এ প্রকল্পে অর্থায়ন না করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নিরুৎসাহী করা যেতে পারে।’