রূপপুর পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে। প্রবল ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এটি সুরক্ষিত থাকবে। দুর্যোগ বা অন্য কারণে বিদ্যুৎ উত্পাদন ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিরাপদে চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) বন্ধ করা যাবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ও সর্বশেষ মডেলের চুল্লি সেখানে স্থাপন করা হবে।
রূপপুর পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসংক্রান্ত কারিগরি কমিটির বৈঠকে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
বৈঠকে রূপপুর পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাবনার রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের (আতমস্ত্রয়েক্সপোর্ত) মধ্যে চারটি চুক্তি হয়েছে।
এসব চুক্তির আওতায় কেন্দ্র নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রকৌশল জরিপ, প্রাথমিক নিরাপত্তা বিশ্লেষণ ও পরিবেশের ওপর প্রভাব নিরূপণ করার কথা। প্রথম ও দ্বিতীয় চুক্তির শতভাগ এবং তৃতীয় চুক্তির ৭২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্থ চুক্তির কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আইন পাস করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার কম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) নামের একটি কম্পানি গঠন করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।
বৈঠকে আরো বলা হয়, রূপপুরে ভিভিআর ১২০০ মডেলের দুটি চুল্লি স্থাপন করা হবে। কেন্দ্রে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা থাকবে। এ চুল্লি মানবসৃষ্ট বিপর্যয় সামলে নিতে সক্ষম। এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে নিতেও সক্ষম। বৈঠকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ভূমিকম্প কত রিখটারে উঠলে চুল্লি সুরক্ষিত থাকবে তা-ও বলা হয়নি।
পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি সূত্র জানায়, রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মতো ক্ষমতা এ কেন্দ্রের থাকবে।
বৈঠকে বলা হয়, জাপানের ফুকোশিমা দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে ভিভিআর ১২০০ মডেল ডিজাইন করা হয়েছে। কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উত্পাদন কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এটিকে নিরাপদে বন্ধ করা যাবে। এই ৭২ ঘণ্টা কেন্দ্রের বাইরে থাকা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে চুল্লি শীতল করার ব্যবস্থা রাখা হবে। কেন্দ্রের কোর ক্যাচার (যেখানে ইউরেনিয়াম রড বসানো হয়) মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে যদি গলেও যায়, এর পরও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে ছড়াবে না।
আরো বলা হয়, রূপপুরে পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তখন এটির ক্ষমতা ধরা হয়েছিল দেড় শ মেগাওয়াট। এখন দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র করা হচ্ছে। তাই আরো জমি প্রয়োজন। এ জন্য পদ্মায় জেগে ওঠা চরের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। আরো ৮০০ একর জমি লাগবে। ইতিমধ্যে এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের অনুমতি সরকার দিয়েছে।
কেন্দ্রের মূল নির্মাণকাজ শুরুর আগে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিছু কাজ প্রায় শেষ। পরিবেশ সমীক্ষণ, মৃত্তিকা পরীক্ষাগার, নির্মাণাগার, কংক্রিট বেসিং প্লান্ট, স্টোরেজ ওয়্যারহাউস, পাম্পহাউস, ওয়ার্কশপ, রিইনফোর্সমেন্ট ওয়েল্ডিং ফ্যাসিলিটি, বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা, অগ্নিনির্বাপণ অবকাঠামো, প্রকৌশলী ভবন ও প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। কেন্দ্রের জন্য যানবাহনও কেনা হয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উত্পাদন শুরু করবে ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় ইউনিট উত্পাদন শুরু করবে পরের বছরে। উত্পাদিত বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি দুই টাকা হতে পারে।
জানা গেছে, রূপপুর পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি চুল্লি বসাতে বিভিন্ন ধরনের প্রায় এক হাজার ৮০০ দক্ষ লোক লাগবে। বাংলাদেশে এ ধরনের জনবল নেই। পুরো জনবল আনতে হবে রাশিয়া থেকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি জনবলের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল হবে। সব সময় বিদেশি জনবলের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা হয়েছে। এগুলো হলো অর্থায়ন, দক্ষ জনবল তৈরি ও অবকাঠামো তৈরি।
সাধারণত জনবিরল স্থানে পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। কিন্তু রূপপুরে কেন্দ্রের গা ঘেঁষেই জনবসতি রয়েছে। কেন্দ্রটিকে শীতল রাখার জন্য ঘণ্টায় প্রায় দেড় লাখ ঘনমিটার পানি দরকার। এত পানি পদ্মা থেকে আনা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত। এ ছাড়া ভিভিআর ১২০০ মডেল একটি নতুন মডেল। এটি এখনো প্রমাণিত মডেল নয়। প্রমাণিত (প্রুভেন) হতে হলে অন্তত ১০ বছর উত্পাদনে থাকতে হয়। এ মডেল নিয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনের ভেতরেই সংশয় রয়েছে। এর আগে ভিভিআর ১০০০ মডেলের কেন্দ্র নির্মাণের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত করেছিল বাংলাদেশ।
0 comments:
Post a Comment